পঞ্চগড় মুক্ত দিবস ও আমাদের রবি

শেয়ার করুন
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদারের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ থেকে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহাকুমার অন্তর্ভুক্ত পঞ্চগড়ও রেহাই পায়নি । তবে তেঁতুলিয়ার প্রবেশপথের চাওয়াই সেতু ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে দেওয়ায় হানাদার বাহিনী আর সামনে এগোতে পারেনি ফলে বর্তমান পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ছিলো মুক্তাঞ্চল৷
শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ (রবি) বাংলার আকাশে চির ভাস্কর এক নাম। তিনি ১৯৫১ সালের ১১জুলাই পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের উত্তর প্রধানপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুড়ুম নদী। এই নদীর বর্ষার স্রোত ও গ্রামের মুক্তজীবন রবিকে করেছে অকুতোভয়। বাড়ির কাছেই ভারতের সীমান্ত। বাবার নাম করিম প্রধান। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। তবে মুক্তিযুদ্ধে তাঁকেও ভারতে পালাতে হয়েছে।
হারুন অর রশিদ নামটি রাখেন দাদা উমের উদ্দিন প্রধান।দেখতে সুদর্শন হওয়ায় রবি নামটি রেখেছেন বোন জামাতা তোজাম্মেল হোসেন। ৯ভাই-বোনের মধ্যে রবি চতুর্থ। বুদ্ধিমত্তার জন্য ভাই-বোনদের মধ্যে রবির ছিলো বাড়তি কদর।রবি পড়ালেখায় ছিলো মেধাবী। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বিএ -এর ছাত্র। ছোট বেলা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রবি ছিলো লৌহবেষ্টনী।
১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সাল এর ২১ফেব্রুয়ারীতে হাড়িভাসা বাজারের কাছে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনারে স্হানীয় লোকেরা রবির নেতৃত্বে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল। শিক্ষার্থীরা ছিল সবার আগে। রবিও ছিল তাদের মধ্যে। ফুল দেওয়ার সময় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা শহীদ মিনারের উপর বুট পড়ে ওঠে । রবি তাদের শহীদ মিনার থেকে নামতে বললে তারা হাসাহাসি শুরু করে৷ রবি তাদের সাথে অস্ত্র ছাড়াই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। উপস্থিত জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গণপিটুনি দেয় এবং কয়েকজনের অস্ত্রও কেড়ে নেয়৷ সে দিন রাতেই এক জিপ পাকিস্তানি সৈন্য অস্ত্রগুলো নিতে আসে। এই ঘটনার জন্য রবিকে পরিবারের অনুরোধে কিছুদিন আত্মগোপন করতে হয়েছে ।
পাকিস্তানিদের নারকীয় কান্ড দেখে এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে রবি একদিন হঠাৎ করে পরিবারের কাউকে না জানিয়েই বড় ভাই হামিদুর রহমানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন । রবির সাহসিকতার কথা এতদিনে অনেকের কাছে পৌঁচ্ছে গেছে । বড় ভাইয়ের সুবাধে সরাসরি তারা হাজির হয় ভারতের জলপাইগুড়ি এলাকায় মুজিব ক্যাম্পে। সেখানেই তাঁরা প্রশিক্ষণ নেন। রবিকে বানানো হয় গ্রুপ লিডার। প্রশিক্ষণ শেষে মে মাসের শেষের দিকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অধীনে রবি ও তাঁর বড় ভাই হামিদুর রহমান যুদ্ধে অংশ নেন।
পঞ্চগড় এর নিকটবর্তী ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর এলাকার কোটগছ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অস্হায়ী ক্যাম্প গড়েন। তাঁরা হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করেন পঞ্চগড়ের ফকিরগঞ্জ, ফকিরের হাট, আলোয়াখোয়া, ফুটকিবাড়ি, নয়নিবুরুজসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে৷ তাঁদের আচমকা আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীরা নাস্তানাবুদ। রবি ছিলো অত্যন্ত সাহসী ও দেশপ্রেমিক।সহযোদ্ধাদের মনোবল ধরে রাখতে ছিলেন দূরদর্শী। সহযোদ্ধাদের সবসময় বলতেন যেভাবেই হোক দেশকে স্বাধীন করতে হবে। ক্রমান্বয়ে পঞ্চগড় শহরের দিকে এগোতে থাকে রবির দল।
এরপর ২৮নভেম্বর রাতে ভারতীয় মিত্র বাহিনীসহ মুক্তিবাহিনী পঞ্চগড় সুগার মিলের পাকিস্তানি ঘাঁটিতে হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিপাগলদের আকস্মিক ও চর্তুদিকের আক্রমণের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকে থাকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা তাদের সরঞ্জাম ফেলে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে।ফলশ্রুত ২৯নভেম্বরের প্রথম প্রহরেই পঞ্চগড় হয় হানাদার মুক্ত।
সকালে রবি দেখলেন তখনও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে পঞ্চগড় সুগার মিলে। রবি দ্রুত নামাতে গেলেন পতাকা৷ সাথে নিয়েছেন বাংলাদেশের ম্যাপ সম্বলিত জয়বাংলা পতাকা। দূরে আধমরা এক পাকিস্তানি সেনা রবিকে টার্গেট করে গুলি করে৷ রক্তে লাল হয় রবি। সহযোদ্ধারা তৎক্ষণাৎ রবিকে বুকে তুলে নেয়৷সহযোদ্ধাদের বুকেই চিরনিদ্রায় স্তব্ধ হন বীর রবি৷
ভারতীয় মেজর শেরকির অত্যন্ত প্রিয় ছিলো রবি। রবির দাফন তাঁর নেতৃত্বে ভারতের কোটগছ বিএসএফ ক্যাম্পের সামনে করা হয়। রবি পরিবারের কাউকে না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও ১৯৭১ সালের ৮আগস্ট বাবার উদ্দেশ্য কোটগছ এলাকা থেকে ছোট ভাই মাহবুব আলম প্রধানের মাধ্যমে একটি চিঠি লিখেন।সেই চিঠির মাধ্যমেই পরিবার জানতে পারে রবির মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা। চিঠিতে তিনি লিখেন( হুবহু তুলে ধরছি)।
দেশকে হানাদার মুক্ত করতে রবি তাঁর কথা রেখেছে নিজের জীবন দিয়ে। বর্তমানে পঞ্চগড় সুগার মিলের একটি ছোট্ট রাস্তা ও রবির গ্রামের বাড়ির দিকে ঢাঙ্গীপুকুর থেকে বাঙ্গালপাড়া সড়কের নামকরণ তাঁর নামে রাখা হয়েছে ৷ স্থানীয় তরুণরা ৯৯এর দিকে শহীদ রবি স্মৃতি সাহিত্য সংসদ গঠন করলেও তা এখন স্থবির। রবির সমাধি এখনও ভারতের কোটগছে। পরিবারের লোকজনও ইচ্ছে করলেও সেখানে আর তেমন যেতে পারে না। প্রতিবছর আড়ম্বরের সাথে পঞ্চগড় মুক্ত দিবস পালন করলেও অনেকে বীরমুক্তিযোদ্ধা রবির বীরত্বের ইতিহাস জানেনা।
নিজের দেশকে স্বাধীন করতে মৃত্যুবরণ করলেও তিনি এখন শুয়ে আছেন অন্য এক দেশে। এটি সত্যিই বেদনাদায়ক। মুজিব বর্ষে শহীদ হারুন অর রশিদের (রবি) সমাধি আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশ স্থানান্তর করা হোক। অন্তত পঞ্চগড় মুক্ত দিবসে সর্বসাধারণ এই বীরের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারবে।